হামহাম জলপ্রপাত। নয়নাভিরাম প্রকৃতির সৌন্দর্যের এক বিস্ময় ‘হামহাম’ জলপ্রপাত একটি। প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজার হাজার দর্শনার্থী ভিড় করেন এই হামহাম জলপ্রপাতের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে। বর্ষা মৌসুমে জলপ্রপাতটির ওপর থেকে প্রচণ্ড শব্দে গড়িয়ে পড়ে ঝরনাধারা। তখন গড়িয়ে পড়া পানির শব্দ শুনে মনে হয় পাহাড়ের কান্না চলছে। তবে হামহাম জলপ্রপাত দেখতে দর্শনার্থীদের পোহাতে হয় অনেক ভোগান্তি। সরাসরি যাতায়াত সুবিধা নেই। টিলাটালা হেটে পৌছাতে হয় মূল গন্তব্যে। সরকারি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়নি কোনো অবকাঠামো ও যোগাযোগ ব্যবস্থা। তবে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন বলছে ‘হামহাম’ জলপ্রপাতে পর্যটকের আকর্ষণ বাড়াতে বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত নয়নাভিরাম প্রকৃতির সৌন্দর্যের এক বিস্ময় ‘হামহাম জলপ্রপাত’। চোখ জুড়ানো এই দৃশ্য দেখতে পাবেন সেখানে টলমলে স্বচ্ছ পানির ধারা গড়িয়ে পড়ছে শক্ত পাথরের মতো পাহাড়ের শরীর লেপটে। নির্জন, শান্ত পাহাড়ের প্রায় দেড় শ’ ফুট উঁচু থেকে কলকল শব্দ বয়ে যাচ্ছে সমতলে। নাম না জানা লতাপাতা, গুল্ম, বাঁশবন, বুনোফুল ও ফলের গাছ আগলে রেখেছে পরম মমতায় সৃষ্টির এক বিস্ময়কে চোখ জুড়ানো ‘হামহাম জলপ্রপাত’। এটিই দেশের অন্যতম জলপ্রপাত।
জানা যায়, সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার প্রায় ৩৮ কি.মি. পূর্ব-দক্ষিণে রাজকান্দি সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কুরমা বনবিটের গহীন অরণ্যঘেরা দূর্গম পাহাড়ি আকাবাকা এলাকায় অবস্থিত এই জলপ্রপাতটি। এটির নাম ও উচ্চতা নিয়ে রয়েছে ভিন্নমত। স্থানীয় বাসিন্দারা একে ‘হামহাম ঝর্না’ বা অনেকে ‘হাম্মাম’ ঝর্না আবার কেউ হাম-হাম বলে ডাকে। এটির উচ্চতা কারো মতে ১৫০-১৬০ ফুট আবার কেউ ১৭০ ফুটের কথা বলেন। সারা বছরই এই জলপ্রপাত থেকে পানি পড়ে। তবে বর্ষা মৌসুমে জলপ্রপাতটি নতুন করে যৌবন ফিরে পায়। এই সময় ঝরনার গতি বৃদ্ধি পায়।
হাম হাম জলপ্রপাত এটি মূলত ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তের কাছাকাছিতে অবস্থিত। এই সময়ে নয়নাভিরাম হামহাম জলপ্রপাত একনজর দেখার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পর্যটকদের আগমনে মুখরিত হয়ে উঠছে জলপ্রপাত এলাকা। দীর্ঘ পাহাড়ের আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু গহীন অরন্যের পথ বেয়ে এই জলপ্রপাত দেখতে প্রতিদিন আগমন ঘটছে বহু পর্যটকের। বিশেষ করে শুক্র ও শনিবার পর্যটকদের ঢল নামে বেশি। যাওয়ার পথের দু-পাশের বনের দৃশ্য যে কোন পর্যটককে মুগ্ধ করতে সক্ষম। বন,পাহাড়, ঝিরিপথ দিয়ে যাওয়ার পথে দেখা মিলবে নানান ধরনের গাছগাছালি, বিভিন্ন পশু ও পাখির।
স্থানীয় বাসিন্দা জানান, ‘এখন হামহাম ঘুড়ে দেখার পুরা মৌসুম। তাই তো ভোর হতেই এখানে পর্যটকরা আসতে থাকেন। কিন্তু সবাই হামহাম যাওয়াতে সফল হননা। রাস্তায় কয়েক দফায় বেশ কিছু আগত পর্যটক ক্লান্ত হয়ে কাঙ্গিত হামহাম ঝর্ণা না দেখেই বাড়ির পথে রওয়ানা দিচ্ছেন। মূলত তরুণরাই হামহাম যাওয়ার দৌড়ে এগিয়ে। ঘুরতে আসা পর্যটকদের মধ্যে ৮০ ভাগই তরুণ-তরুণী। দৃঢ় মনোবল থাকলে হামহাম ঝর্ণার রূপ দেখা সম্ভব বলে মনে করেন তারা।
এদিকে ঘুড়তে আসা পর্যটক এ আর সাব্বির চৌধুরী বলেন, ‘কার না ভালো লাগে এই জায়গায় আসতে একটু কষ্ট হলেও ভালো লাগে ভেতরের ঝর্না দেখে। কিন্তু ,একটা বড় সমস্যা শুধু এখানে কোন হোটেল না থাকায়। আমরা সেখানে গিয়ে একজন বাবুর্চিকে দিয়ে রান্না করে ২৫ জন মানুষ খেয়েছি। যদি সেখানে কোন ভালো হোটেল থাকতো তাহলে ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্য আর কোন সমস্যা হতো না। তিনি আরও বলেন, যদি সেখানকার উপজেলা প্রশাসন হোটেল মোটেল ও থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন তাহলে পর্যটন শিল্পে আরও উন্নতি হবে।’
কমলগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘হামহাম জলপ্রপাতে পর্যটকের আকর্ষণ বাড়াতে ইতিমধ্যে বেশকিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারি উদ্যোগে অবকাঠামো এবং যোগাযোগের সুবিধা বাড়াতে কাজ করা হচ্ছে। পর্যটনশিল্পের টেকসই উন্নয়নে সরকারি ও ব্যক্তিসহযোগিতা বাড়ানো প্রয়োজন।’
কিভাবে যাবেন সেখানে…
দেশের বিভন্ন প্রান্ত থেকে মৌলভীবাজার আসার ব্যবস্থা আছে। যেমন- ট্রেন,বাস, প্রাইভেট কার ও মোটরসাইকেল যোগে। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে রাজকান্দি রেঞ্জের কুরমা বনবিট এলাকার পশ্চিম দিকে চম্পারায় চা-বাগান। এই কুরমা বনবিটের প্রায় আট কিলোমিটার ভেতরে দৃষ্টিনন্দন এই হামহাম জলপ্রপাত। এটি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যসীমান্তে অবস্থিত। এখানে সরাসরি পৌঁছানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। উপজেলা চৌমুহনা থেকে কুরমা চেকপোস্ট পর্যন্ত প্রায় ২৫ কিলোমিটার যান চলাচলের ব্যবস্থা রয়েছে। বাকি পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ হেঁটে যেতে হয়। গাইড না নিলে রাস্তা হারিয়ে পড়তে পারেন মহা বিপদে। কারণ, রাস্তায় কোনো সমস্যা হলে কাউকে না পাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। পাথরের পাহাড়ের ঝিরি পথে হেঁটে যেতে যেতে সুমুধুর পাখির কলরব ও ঝিঝি পোকার শব্দে মনকে ভাললাগার অনুভূতিতে ভরিয়ে দেবে। এভাবেই হাটতে হাটতে একসময় পৌঁছে যাবেন আপনার কাক্ষ্খিত হামহাম জলপ্রপাতের কাছাকাছি। এছাড়াও যাবার সময় চোখ পড়বে চা-বাগানের অপূর্ব দৃশ্যে।