করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এলেও এর সংক্রমণ রোধে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা সীমান্ত হাট খুলে দেওয়া হয়নি দীর্ঘ চার বছরেও। কবে নাগাদ হাট খুলে দেওয়া হবে- সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট তথ্য নেই সীমান্ত হাট ব্যবস্থাপনা কমিটির কাছে। আর হাট না খুলে দেওয়ায় চরম অর্থকষ্টে আছেন ব্যবসায়ীরা। এছাড়া পাইকারিতে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্য বিক্রির অর্থও আদায় করতে পারছেন না তারা। দেশের অন্য সীমান্ত হাটগুলো চালু করে দেওয়া হলেও কসবা সীমান্ত হাট না খোলায় হতাশ ব্যবসায়ীরা।
মূলত বাণিজ্যে ‘সমতা’ না থাকায় সীমান্ত হাটটি বাংলাদেশের জন্য অনেকটাই ‘অলাভজনক’। এছাড়া হাটে সীমান্তের বাইরের এলাকার ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড়ের কারণে সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দারা হাটের সুফল পুরোপুরি ভোগ করতে পারেননি। ফলে এটি খোলার ব্যপারে ‘ধীরে চলো’ নীতিতে হাঁটছে হাট ব্যবস্থাপনা কমিটি। তবে দ্রুত হাটটি খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়ে ব্যবসায়ী বলছেন, সীমান্তের বাইরের ক্রেতাদের নিয়ন্ত্রণ করা গেলেই দু’দেশের বাণিজ্যে সমতা ফিরে আসবে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী ৫ কিলোমিটার এলাকার বাসিন্দাদের জন্য দু’দেশের যৌথ উদ্যোগ এবং অর্থায়নে সীমান্ত হাট স্থাপন করা হয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার তারাপুর সীমান্ত এবং ভারতের সীপাহিজলা জেলার কমলাসাগর সীমান্তে ২০১৫ সালের জুনে যাত্রা শুরু হয় সীমান্ত হাটের। বাংলাদেশ অংশে এটি কসবা সীমান্ত হাট নামেই বেশি পরিচিত।
হাটে দু’দেশের ৫০টি করে মোট ১০০টি দোকান রয়েছে। প্রতি রোববার ছিল হাটবার। আর হাটে বাংলাদেশি পণ্যগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হতো কাপড়, প্লাস্টিক ও লৌহজাত পণ্য। ভারতীয় পণ্যের মধ্যে প্রসাধনী, শাড়ি, থ্রি-পিস ও শিশুদের ডায়াপারের চাহিদাই ছিল বেশি। তবে শুরু থেকেই হাটে ভারতীয় পণ্যের বেচাকেনা ছিল বেশি। এছাড়া হাটটি দু’দেশের সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের জন্য মিলনমেলারও স্থান ছিল।
মূলত সীমান্তের ৫ কিলোমিটার এলাকার বাসিন্দাদের জন্য হলেও হাটে প্রবেশ করা ক্রেতাদের মধ্যে সীমান্তের বাইরের এলাকারই ছিলেন বেশি। তাদের অধিকাংশই ব্যবসার উদ্দেশ্যে ব্যাগভর্তি করে ভারতীয় পণ্য কিনে নিয়ে যেতেন। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদস্যদের চোখ ফাঁকি দিয়েই নিয়মিত এ কাজটি করতেন তারা। এতে করে হাটে ভারতীয় পণ্যের বেচাকেনা ছিল বেশি। ফলে দু’দেশের বাণিজ্যে সমতা ছিলনা।
তবে করোনা মহামারি দেখা দিলে ২০২০ সালের ১০ মার্চ থেকে সীমান্ত হাটের কার্যক্রম অনির্দিষ্টকালে জন্য বন্ধ ঘোষণা করে দুই দেশের হাট ব্যবস্থাপনা কমিটি। হাট বন্ধের আগে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ২৬ লাখ ৯৮ হাজার টাকার বাংলাদেশি বিভিন্ন পণ্য বিক্রি হয়েছিল। আর ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ৩৭ লাখ ৭২ হাজার টাকার এবং ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশি পণ্য কেনাবেচা হয়েছে ২০ লাখ ৭৭ হাজার টাকার। তবে এ সময়ে ভারতীয় পণ্য দ্বিগুণেরও বেশি কেনাবেচা হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাট সংশ্লিষ্টরা।
এ দিকে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় হাটের দোকানঘরের অবকাঠামো নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সম্প্রতি সেগুলো সংস্কার করে হাট ব্যবস্থাপনা কমিটি। তবে এখনও পর্যন্ত হাট খুলে না দেওয়ায় অসন্তোষ জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের অনেকেরই চরম অর্থকষ্টে দিন কাটছে। এছাড়া ব্যবসায়ীদের অনেকেরই ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছে পাইকারিতে বিক্রি করা পণ্যের মূল্য পাওনা রয়েছে- যা হাট না খোলায় আদায় করা যাচ্ছে না।
কসবা সীমান্ত হাটের ব্যবসায়ী লিটন কর্মকার জানান, তিনি লৌহজাত, তামা এবং কাঁসার তৈরি বিভিন্ন তৈজসপত্র বিক্রি করতেন হাটে। হাট বন্ধ হওয়ার আগে অনেক টাকার মালামাল অবিক্রিত রয়ে যায়। পরবর্তী সেগুলো কম মূল্যে বিক্রি করতে গিয়ে বড় অংকের লোকসান গুণতে হয়েছে। তবে দীর্ঘ ৪ বছরেও হাট না খোলায় চরম অর্থকষ্টে আছেন বলে জানান তিনি।
হাটের আরেক ব্যবসায়ী মিণ্টু মিয়া জানান, প্রতি হাটবারে তিনি অন্তত ৫০ হাজার টাকার বিভিন্ন ফল বিক্রি করতেন। ভারতীয় ক্রেতাদের কাছে বাংলাদেশি ফলের চাহিদা বেশি ছিল। ফলে ভারতীয় ব্যবসায়ীরাও তার কাছ থেকে ফল কিনে নিয়ে যেতেন। হাট বন্ধের কারণে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের কাছে ফল বিক্রি বাবদ পাওনা প্রায় ৪ লাখ টাকা আদায় করতে পারছেন না বলে জানান তিনি।
হাটের আরেকজন ব্যবসায়ী আজহারুল হক জানান, হাটটি খোলার বিষয়ে বারবার আশ্বাস দেওয়া হলেও খুলে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ দেশের অন্য সীমান্ত হাটগুলো চালু করে দেওয়া হয়েছে অনেক আগেই। দীর্ঘদিন ধরে হাট বন্ধ থাকায় অনেক ব্যবসায়ী অর্থকষ্টে মানবেতর দিন কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ রিকশা বা ইজিবাইক চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করছেন বলেও জানান তিনি।
কসবা সীমান্ত হাট ব্যবসায়ী কমিটির (বাংলাদেশ অংশ) সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ওয়ালিউল্লাহ সরকার বলেন, ‘হাটটি সীমন্তবর্তী এলাকার বাসিন্দাদের জন্য হলেও সবসময় বাইরের ক্রেতাদের উপচেপড়া ভিড় ছিল ভারতীয় দোকানগুলোতে। ফলে প্রায় ৫ বছর হাট চললেও এর সুফল পুরোপুরি ভোগ করতে পারেননি সীমান্তবর্তী এলাকার বাসিন্দারা। হাটে দু’দেশের বাণিজ্যে সমতা না থাকার প্রধান কারণ হলো- সীমান্ত এলাকার বাইরের বাসিন্দাদের হাটে অবাধে প্রবেশ এবং ব্যাগভর্তি করে ভারতীয় পণ্য কেনা’।
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যতটুকু জানতে পেরেছি যে, বাণিজ্যে সমতা না থাকার কারণেই হাটটি পুনরায় খোলার বিষয়ে খুব একটা উদ্যোগী নয় সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে সীমান্তের বাইরের এলাকার যেসব ক্রেতা ব্যবসার উদ্দেশ্যে ভারতীয় পণ্য কিনে নিয়ে যান- তাদেরকে যদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তাহ বাণিজ্যে সমতা ফিরে আসবে’- উল্লেখ করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও সীমান্ত হাট ব্যবস্থাপনা কমিটির (বাংলাদেশ অংশ) সভাপতি জেসমিন সুলতানা বলেন, ‘দীর্ঘদিন হাট বন্ধ থাকায় অবকাঠামোগুলো নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। সেগুলোর সংস্কার কাজ এখনও চলছে। এটি শেষ হওয়ার পর হাটটি খোলার ব্যপারে হয়তো বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা আসবে। তবে কবে নাগাদ হাট খুলে দেওয়া হবে- সেটি স্পষ্ট করে বলা যাচ্ছে না’।
তিনি আরও বলেন, ‘সীমান্তের বাইরের এলাকার ক্রেতাদের হাটে অবাধ প্রবেশের বিষয়ে ব্যবসায়ীদের অভিযোগটি খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাণিজ্যে সমতা আনতে দু’দেশের যৌথ আলোচনার মাধ্যমে হাটের সমস্যাগুলো নিরসন করা হবে’।