পাঠ্যপুস্তকে অন্যতম সমস্যা হল, মুসলিমদেরকে লুটেরা, ক্ষমতালোভী হিসেবে বৃটিশদের সাথে এক কাতারে দেখানো।
“বৃটিশও লুটপাট করেছে, মুসলমানরাও লুটপাট করেছে” – এর চেয়ে বড় ঐতিহাসিক মিথ্যা আর নেই।
দেখা যাক, স্কলাররা কী বলেছেন। অনেক হিন্দুর মনে প্রশ্ন হল, বৃটিশরা দখলদার হলে মুসলিমরাও দখলদার এই উপমহাদেশে।
মুসলিমরা এদেশে এসে এদেশীয় হয়ে গেছে।
~ দীনেশচন্দ্র সেন বলেছেন:
“গৌড়দেশ মুসলমানগণের অধিকৃত হইয়া গেলো। তাঁহারা ইরান-তুরান যে দেশ হইতেই আসুন না কেন, বঙ্গদেশ বিজয় করিয়া বাঙ্গালী সাজিলেন”।
(শ্রী দীনেশচন্দ্র সেন, প্রবন্ধ : বঙ্গ-ভাষার ওপর মুসলমানের প্রভাব, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান, পৃষ্ঠা : ১৮-১৯)
* তিনি আরও বলেন:
“তুর্কিরা এদেশে বাস করিয়া এদেশের একরূপ অধিবাসী হইয়া পড়িয়াছিলেন, তাঁহারা বাঙ্গালা কথা কহিতে ও লিখিতে জানিতেন।… [দীনেশচন্দ্র সেন, বৃহৎ বঙ্গ, খণ্ড-২, প্রাগুক্ত, পৃ. ৯৭৭।]
* আচার্য দীনেশ চন্দ্র সেন আরও মন্তব্য করেছেন,
“আজ হিন্দুর নিকট বাঙ্গলাদেশ যেমন মাতৃভৃমি, সেদিন হইতে মুসলমানের নিকট বাঙ্গলাদেশ তেমনই মাতৃভুমি হইল৷তাঁহারা এদেশে আসিয়া দস্তুরমত এদেশবাসী হইয়া পড়িলেন৷ হিন্দুর নিকট বাঙ্গলা ভাষা যেমন আপনার, মুসলমানদের নিকট উহা তদপেক্ষা বেশী আপনার হইয়া পড়িল৷
বঙ্গভাষা অবশ্য বহু পূর্ব হইতে এদেশে প্রচলিত ছিল, বুদ্ধদেবের সময়ও ইহা ছিল, আমরা ললিত বিস্তরে তাহার প্রমাণ পাইতেছি। কিন্তু বঙ্গ-সাহিত্যকে একরূপ মুসলমানের সৃষ্টি বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না।… মুসলমান সম্রাটগণ বর্তমান বঙ্গ- সাহিত্যের এইরূপ জন্মদাতা বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। … বঙ্গ সাহিত্য মুসলমানদেরই সৃষ্ট, বঙ্গভাষা বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা।”
[ সুত্র : দীনেশ চন্দ্র সেন বঙ্গ-ভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব, ‘সওগাত’, ১৩৩৫ সালের চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত, সংগৃহীতঃ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিম অবদান, মোশাররফ হোসেন খান (সম্পাদিত)]
অধ্যাপক শাহনেওয়াজ লেখেন:
“বাংলা ভাষা, সাহিত্য সর্বোপরি বাঙালির সৌভাগ্য যে বিদেশাগত সুলতানরা বাংলার শাসন ক্ষমতায় এসে অচিরেই নিজ কর্মভূমিকায় বাঙালি হয়ে গেলেন। … বাংলার অবাঙালি শাসকরাও ততদিনে বাংলার জল-মাটির সঙ্গে একাকার হয়ে গিয়েছেন। পিতৃভূমিতে ফিরে যাওয়ার কোনো আগ্রহ আর তাদের ছিল না। সুতরাং বাংলা আর বাঙালির শ্রীবৃদ্ধিতে তারা অকুণ্ঠ চিত্তে ভূমিকা রেখেছেন”।
[এ কে এম শাহনাওয়াজ (অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়) | ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সুলতানি আমলে বাংলা ভাষার বিকাশ, দেশ রূপান্তর। ]
দ্বিতীয়ত, মুসলিমরা এদেশে এসেছে থাকতে। সম্পদ পাচার করতে নয়। তারা এদেশ থেকে নিয়ে নিজ দেশে পাচার করেনি। বরং এদেশকে বাংলা ভাষা, জাতীয়তা, স্থাপত্য, ধর্ম, আইনশাস্ত্র উপহার দিয়েছে। এই ভারতীয় উপমহাদেশে বৃটিশরা আজ কোথায়? তারা নেই। কারণ উপনিবেশ শেষে সাথে সাথে তারা তল্পিতল্পা গুটিয়ে চলে গেছে।
তৃতীয়ত, মুসলিমদেরকে যদি দখলদার বলা হয়, তাহলে সনাতনীরাও দখলদার। আর্যরাও এদেশ দখল করে অনার্যদেরকে শুদ্রে রুপান্তরিত করেছে। আমাদের অনার্য পূর্বপুরুষদেরকে নির্যাতন-শোষণ করে নিজেরা ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় সেজেছে। মানে দাদা নিজের জালে নিজে ফেঁসে যাচ্ছে। আর্যরা এদেশ দখল করে কী কী করেছে, সে আলাপ আরেক দিন।