বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দেশজুড়ে সহিংসতায় রূপ নেয়ার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সরকার শুক্রবার মধ্যরাত থেকে কারফিউ জারি ও সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুক্রবার রাতে যখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও আইনশৃঙ্খলার সাথে জড়িত বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার প্রধানদের সাথে বৈঠক করেন, তার আগে সারাদিন ধরে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে ঢাকাসহ প্রায় সারাদেশে।
এর মধ্যে বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম বিটিভি, মেট্রো রেলস্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, সেতু ভবন, বিভিন্ন থানাসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় আগুন এবং নরসিংদীতে কারাগারে আগুন দিয়ে শত শত বন্দীর পালানোর ঘটনা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয় সরকারের মধ্যে।
এরপরই সন্ধ্যায় প্রথমে ১৪-দলীয় জোট নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। পরে বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের সঙ্গে বৈঠকের পর কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন তিনি। রাতেই কারফিউ বলবৎ হওয়ার কিছুক্ষণ আগে এসব সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
এর আগে চলতি বছরের পাঁচই জুন হাইকোর্ট কোটা পদ্ধতি বাতিল করে সরকারের ২০১৮ সালে জারি করা পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে। তাৎক্ষণিকভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা শাহবাগে প্রতিবাদ করতে শুরু করে। এরপর কয়েকদিন ধরে ধারাবাহিক প্রতিবাদের মধ্যেই এক পর্যায়ে তারা সরকারকে স্থায়ীভাবে কোটা সংস্কারের জন্য আলটিমেটাম দেয়।
এরপর থেকে ঈদুল আযহার বিরতি ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই শাহবাগ এলাকায় সড়ক অবরোধ করে কর্মসূচি পালন করে আসছিলো আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। পরে তারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে প্রতিবাদ করতে শুরু করে, যা শেষ পর্যন্ত তুমুল সহিংসতায় রূপ নেয়ার পর শুক্রবার রাতে কারফিউ জারি করে সেনা মোতায়েন করলো সরকার।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীন বিবিসিকে বলেছেন সহিংসতার কারণেই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, যার দায় উভয় পক্ষেরই। ‘তবে এমন পরিস্থিতি তৈরিই হতো না যদি সরকার আগেই আলোচনার উদ্যোগ নিতো,” বলছিলেন তিনি।
আরেকজন বিশ্লেষক শারমীন আহমেদও মনে করেন শিক্ষার্থীদের সাথে দ্রুততম সময়ে সমাধানে আসার প্রয়োজন ছিলো।
বিক্ষোভ থেকে সহিংসতা
এরপর থেকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নেমে আসে। তাদের দাবি হচ্ছে, ‘রাজাকারের’ সাথে তুলনা করে প্রধানমন্ত্রী তাদের সম্মানে ‘আঘাত’ করেছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিচ্ছেন – “তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার।” যদিও এই শ্লোগান পরবর্তীতে সমালোচনা সৃষ্টি করে।
একদিন পরে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এর তীব্র সমালোচনা করেন।
ওবায়দুল কাদের প্রশ্ন তোলেন, আন্দোলনকারীরা নিজেদেরকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বা দেশবাসীর পক্ষে না ভেবে রাজাকার ভাবলো কেন? তাদেরকে তো কেউ রাজাকার বলেনি।
“প্রধানমন্ত্রী তো কোটা আন্দোলনের কাউকে উদ্দেশ্য করে রাজাকার শব্দটি ব্যবহার করেননি। এই আন্দোলনকারীদের একটা অংশ রাজাকারের পক্ষ অবলম্বন করছে এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার। এর পৃষ্ঠপোষক হচ্ছে বিএনপি জামাত, এর পেছনে আছে তারেক রহমান,” বলেন মি. কাদের।
“এই আত্মস্বীকৃত রাজাকার যারা নিজেদের ঔদ্ধত্যপূর্ণ মানসিকতার প্রকাশ ঘটিয়েছে…আন্দোলন সামলানোর জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট’ এমন মন্তব্য করেন তিনি।
মঙ্গলবার পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি ছিলো কোটা আন্দোলনকারী ও ছাত্রলীগের। সেদিন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা হামলা করলে ব্যাপক সহিংসতা শুরু হয়। ছাত্রলীগ বহিরাগতদের নিয়ে হামলা করেছে বলে অভিযোগ করে আন্দোলনকারীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর, সিলেটের শাহজালাল ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন ক্যাম্পাসেও সংঘর্ষ শুরু হয়ে যায়।
আবু সাইদের মৃত্যু
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদের মৃত্যুর ঘটনায় সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশেই। সেদিন আবু সাইদসহ ছয় জন সহিংসতায় নিহত হয়।
মঙ্গলবার রাতেই ঢাকা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের বের করে দিয়ে তাদের কক্ষ ভাংচুর করে শিক্ষার্থীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতাদের কক্ষও ভাঙ্গচুর করা হয়। এক পর্যায়ে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বের করে দেয়া হয়।
বুধবার আশুরার ছুটির দিনে কঠোর কোন কর্মসূচি ছিলো না কোন পক্ষ থেকেই। এদিন সহিংসতা না হলেও বৃহস্পতিবার থেকে কোটা আন্দোলনকারীরা ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি ঘোষণা করে।
এই কর্মসূচি ঘোষণার পর থেকে ভয়াবহ সহিংসতা শুরু হয় ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায়, যা তীব্র আকার ধারণ করেন শুক্রবারে।
এ দুই দিনে ঢাকায় সরকারি-বেসরকারি অসংখ্য স্থাপনায় হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। বৃহস্পতিবার বিটিভি ভবনে হামলা ও অগ্নিসংযোগ হলে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিভিশনটির সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। বৃহস্পতিবার উত্তরা এলাকায় কয়েক ঘণ্টা ধরে সংঘর্ষ হলে বেশ কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যার পর থেকে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়ে যায়।
এদিন সারা দেশে সংঘর্ষে অন্তত ২৫ জন নিহত হয়।
শুক্রবারের সহিংসতা
শুক্রবার সহিংসতা আরো বেড়ে যায়। ঢাকার অনেক এলাকা কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
পুলিশ, বিজিবি ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতাকর্মীদের সাথে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ ঘটতে থাকে। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সব পয়েন্টে যান চলাচল ও ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়।
ঢাকার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জে নগর ভবনে হামলা হয় এবং একটি বাস কোম্পানির ২৬টি বাস পুড়িয়ে দেয়া হয়। ঢাকার বহু জায়গায় এদিন ভবনে ও রাস্তায় আগুন জ্বলতে দেখা যায়।
উত্তরা এলাকায় হামলা হয় গাজীপুরের সাবেক মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের ওপর। এ ঘটনায় তার এক সহযোগী নিহত হয়। এছাড়া নরসিংদীতে কারাগার ভেঙ্গে শত শত কয়েদী বেরিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি সেখানে জেলা পরিষদ ভবনসহ কয়েকটি সরকারি স্থাপনায় আগুন দেয়া হয়।
ঢাকার দৈনিক প্রথম আলোসহ কয়েকটি পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, শুধুমাত্র শুক্রবারের সহিংসতায়ই ৫৬ জন নিহত হয়েছে এবং এর মধ্যে ৪৪ জনই মারা গেছে রাজধানী ঢাকায়। এদিন অনেকগুলো সরকারি স্থাপনায় ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
সংবাদপত্রগুলো তাদের খবরে দাবি করেছে যে ‘সংঘর্ষে তিন দিনে ১০৩ জন নিহত’ হয়। এসব খবরে বলা হয় নিহত ও আহতদেরে মধ্যে বিক্ষোভকারী, শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, পথচারি, রাজনৈতিক দলের কর্মী ও আইনশৃংখলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য রয়েছেন।
অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি নিহত হয়েছে বৃহষ্পতি ও শুক্রবার। এই দুই দিনে নিহত হয়েছে অন্তত ৯৭ জন।
কারফিউ ঘোষণা
শুক্রবার দুপুরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকসহ মন্ত্রিসভার তিনজনের সঙ্গে বৈঠক করে শিক্ষার্থীদের সাথে আলোচনার জন্য দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাতে তাদের সঙ্গে বৈঠক করে আট দফা দাবি উপস্থাপন করেন সারজিস আলমসহ কোটা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারীদের তিন জন।
শুক্রবার রাতেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুোর নেতা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ঊর্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক শেষে কারফিউ জারি এবং সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেন।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রথম ধাপে শুক্রবার রাত বারটা থেকে শনিবার দুপুর বারটা পর্যন্ত কারফিউ চলার পর দু’ঘণ্টার জন্য শিথিল করা হয়েছিলো। দ্বিতীয় ধাপে আজ শনিবার দুপুর দু’টা থেকে রবিবার সকাল দশটা পর্যন্ত কারফিউ জারি থাকার কথা জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
শনিবার সকাল থেকেই ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে সেনা সদস্যদের চেকপোস্ট বসিয়ে কাজ করতে দেখা যায়।
তারপরেও শনিবারও ঢাকার যাত্রাবাড়ী, রামপুরা-বনশ্রী, সাভারসহ অনেক এলাকায় সহিংসতার ঘটনা ঘটে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জোবাইদা নাসরীন মনে করেন উভয় পক্ষের ভূমিকাই কারফিউ পরিস্থিতি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে।
“আন্দোলনকারীরাও শেষ পর্যন্ত আন্দোলন তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেনি বলেই মনে হচ্ছে। কাজেই সহিংসতার দায় তারাও এড়াতে পারে না। আবার সরকার চাইলে গত মঙ্গলবারেই আলোচনার উদ্যোগ নিতে পারতো। তাহলে পরিস্থিতি এ পর্যায়ে আসতোই না। সবমিলিয়েই কারফিউ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।”
আরেকজন বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডার বিভাগের চেয়ারপার্সন শারমীন আহমেদ বলছেন শিক্ষার্থীদের ‘যৌক্তিক আন্দোলনকে’ একটি নৈরাজ্য সৃষ্টিকারী গোষ্ঠী ব্যবহার করতে পারে- এটি বুঝে সরকারের দ্রুতই শিক্ষার্থীদের সাথে সমাধানে আসা দরকার ছিলো।
তিনি বলেন, “আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নৈরাজ্যকারীদের উদ্দেশ্য, শক্তি ও পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা না নিয়ে, সমস্যা সমাধানে আত্মবিশ্বাস দেখানোই কারফিউ জারির পরিস্থিতি তৈরি করেছে।”
লেখকঃ রাকিব হাসনাত
তথ্যসুত্রঃ বিবিসি নিউজ বাংলা