দক্ষিণ সুদানের আইএসপি এ খাতের ৫০ শতাংশ বাজার বাংলাদেশি চার কোম্পানির দখলে, বাৎসরিক টার্নওভার প্রায় ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কোম্পানির আকার হিসেব করলে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছে।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের উদ্যোক্তা কামরুল হাসান প্রশিক্ষণ ও সেবা প্রদানের জন্য ২০১১ সালে দক্ষিণ সুদানে প্রতিষ্ঠা করেন আইপিটেক লিমিটেড। দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর ওই বছরই স্বাধীন হয়েছে আফ্রিকার দেশটি।
সদ্যস্বাধীন দেশটির ডিজিটাল অবকাঠামো নির্মাণের জন্য তখন বিনিয়োগের প্রয়োজন হয়েছিল। আর সেই সুযোগটাই লুফে নিয়েছিলেন পটুয়াখালীতে জন্ম নেওয়া বাংলাদেশি উদ্যোক্তা কামরুল।
২০১২ সালে দুজন বাংলাদেশি অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাসহ মোট চারজন মিলে ফাস্ট নেটওয়ার্ক লিমিটেড নামে একটি ইন্টারনেট সেবাদাতা (আইএসপি) কোম্পানি শুরু করেন কামরুল হাসান। এর মাধ্যমে দক্ষিণ সুদানে প্রথম বাংলাদেশি আইএসপি কোম্পানির যাত্রা শুরু হয়। ২০১৪ সালে কামরুল ফাস্ট নেটওয়ার্কে তার শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে আইপিটেক লিমিটেডের অধীনে আলাদাভাবে আইএসপি ব্যবসা শুরু করেন।
এরপর ২০১৬ ও ২০১৭ সালে বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের নেতৃত্বে আফ্রিকার দেশটিতে ব্যবসা শুরু করে আরও দুটি আইএসপি কোম্পানি—স্মার্ট নেটওয়ার্ক ও জুবা নেটওয়ার্ক কোম্পানি লিমিটেড।
দক্ষিণ সুদানে এখন মোট ৩৬টি নিবন্ধিত আইএসপি কোম্পানি আছে। এরমধ্যে ২০টিরও কম কোম্পানি চালু রয়েছে। এ খাতের ৫০ শতাংশ বাজার বাংলাদেশি চার কোম্পানির দখলে, বাৎসরিক টার্নওভার প্রায় ১৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কোম্পানির আকার হিসেব করলে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছে। বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোতে মোট ২৫০-র মতো জনবল আছে।
আইপিটেক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কামরুল বলেন, ‘নতুন একটি দেশ, যেখানে কোন ধরনের অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি, সেখানে বিনিয়োগ করা কতটা নিরাপদ, সেটি নিয়েও সংশয় ছিল। তবে শুরু থেকেই উন্নয়ন সংস্থা, শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরত বাংলাদেশি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আমাদের অভয় দিয়েছেন, উৎসাহিত করেছেন। আমরাও শুরু করেছিলাম।
‘চাকরি করতে এসে অনেক বাংলাদেশি উদ্যোক্তা হয়েছেন। বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো বর্তমানে ভালো করছে।’
সুদানে কামরুলের যাত্রা অবশ্য শুরু হয় দেশটি স্বাধীন হওয়ার আগে থেকেই। ২০১০ সালে পোল্যান্ডভিত্তিক কোম্পানি ট্রাইকম দেশটির টেলিকউনিকেশন খাত গঠনের একটি প্রকল্পের কাজ পায়। ওই প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন বাংলাদেশি প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ কামরুল হাসান।
কামরুল দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ‘দক্ষিণ সুদানের টেলিকমিউনিকেশন খাতের গড়ে ওঠা, ফাইবার অপটিক স্থাপন, আন্তর্জাতিক গেটওয়ে ও ডাটা সেন্টার স্থাপন, টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি প্রতিষ্ঠায় সহায়তা, আইএসপি কোম্পানির নীতিমালা প্রণয়ন আমাদের হাত ধরে হয়েছে।’
‘বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিরা শ্রমিক বা কম গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করছেন। তবে এখানে পরিস্থিতি ভিন্ন। আমরা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে কাজ করছি,’ বলেন তিনি।
যুক্তরাজ্যের লন্ডন মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমে ডিগ্রি নেওয়ার পর কামরুল পোল্যান্ডের কোম্পানিটিতে যোগ দেন। ট্রাই কমে যোগদানের আগে তিনি ঢাকায় ড্যাফোডিল অনলাইন নামে একটি কোম্পানিতে কাজ করেছেন।
১১ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশটি দক্ষিণ সুদানে মোট ৮ লাখেরও কম মানুষ ইন্টারনেট সেবার অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছে। দরিদ্রপ্রবণ দেশটিতে প্রযুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো না থাকায় অনেক ব্যয় করতে হয়। এজন্য দেশটিতে ব্যক্তি পর্যায়ের ইন্টারনেট ব্যবহারকারী একেবারে কম, অধিকাংশ ব্যবহারকারী বা সাবস্ক্রাইবারই প্রাতিষ্ঠানিক।
বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা বলছেন, ১৫-২০ বছর আগে বাংলাদেশে যেমন পরিস্থিতি ছিল, বর্তমানে দক্ষিণ সুদানে একই অবস্থা।
উদ্যোক্তারা জানান, দক্ষিণ সুদানে এক এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য মাসে ১৫০-২০০ মার্কিন ডলার ব্যয় করতে হয়। বাংলাদেশে মাত্র ৮০০-১,০০০ টাকায় ১০ এমবিপিএস গতির ইন্টারনেট ব্যবহার করা যায়।
দক্ষিণ সুদানে আরেক বাংলাদেশি উদ্যোক্তা, জুবা নেটওয়ার্ক কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান সোহেল মোহাম্মদ আবদুল্লাহ টিবিএসকে বলেন, ‘কেনিয়া এবং উগান্ডা—এই দুই দেশ পার হয়ে দক্ষিণ সুদানে ব্যান্ডউইথ আসে। এসব কারণে ব্যয় অনেক বেশি বহন করতে হয়। এছাড়া যন্ত্রপাতিও আমদানি করতে হয় উচ্চমূল্যে। এসব কারণে পরিচালন ব্যয় অনেক বেশি।’
সোহেল চট্টগ্রামের প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। স্থানীয় একটি আইএসপি কোম্পানিতে কাজ করার পর ২০১২ সালে তিনি দক্ষিণ সুদানের একটি আইএসপি কোম্পানিতে চুক্তিভিত্তিক চাকরি শুরু করেন। ২০১৪ সালে দেশের একটি ব্যাংকের আইটি পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ শুরু করেন। অবশেষে ২০১৭ সালে তিনি জুবা নেটওয়ার্ক কোম্পানি লিমিটেড প্রতিষ্ঠা করেন।
সোহেল আরও বলেন, ‘আগে ইন্টারনেট সেবা ছিল স্যাটেলাইটনির্ভর। তখন ইন্টারনেটের গতিও ধীর ছিল। আমাদের প্রচেষ্টায় উগান্ডার সীমান্তে ফাইবার স্থাপন হয়েছে। ওই সীমান্ত সড়কে টাওয়ারসহ নেটওয়ার্ক স্থাপন হয়েছে।
‘বর্তমানে আমরা সব ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছি। ফলে ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধি পেয়েছে।’
কামরুল হাসান জানান, ‘অর্থায়নের অভাবে দক্ষিণ সুদানে অবকাঠামো গড়ে ওঠেনি। পরে সরকার বেসরকারি খাতের ওপর পুরো খাতটি ছেড়ে দেয়। নিজস্ব অবকাঠামো না থাকায় বেশি ব্যয় করতে হয়।’
দেশের অর্থনীতিতে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ কামরুল হাসানকে ২০২৩ সালে বাংলাদেশ সরকার কমার্শিয়ালি ইম্পরট্যান্ট পারসনের (সিআইপি) স্বীকৃতি দিয়েছে। ‘বৈধ চ্যানেলে সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা পাঠানো প্রবাস’ ক্যাটাগরিতে তাকে এই স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে যাওয়া সোহেল মুহাম্মদ আবদুল্লাহও দক্ষিণ সুদানের ন্যাশনাল চেম্বার অভ কমার্স, ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচারের কাছ থেকে ‘চেম্বার কোয়ালিটি অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’-এ ভূষিত হয়েছেন।
২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত দক্ষিণ সুদানের জনসংখ্যা ছিল ১১ মিলিয়ন। ডাটারিপোর্টাল-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ওই বছরের শুরুতে দেশটিতে ৭.৭৩ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী, ৪.৭০ লাখ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী এবং মোট ৩.৫৮ মিলিয়ন সক্রিয় সেলুলার মোবাইল সংযোগ ছিল।
বাজারের নেতৃত্বে বাংলাদেশিরা
দীর্ঘ দীর্ঘগৃহ যুদ্ধের পর ২০০৫ সাল শান্তি চুক্তি হয় আফ্রিকার স্বল্পোন্নত দেশ সুদানের দুই অংশের মধ্যে। সেই থেকেই আলাদা দেশ হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছিল দক্ষিণ সুদান। জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা নিয়োজিত ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, বাংলাদেশি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকও কাজ করে আফ্রিকার এই পিছিয়ে পড়া অঞ্চলে।
এছাড়া জাতিসংঘসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরাও বাংলাদেশি ছিলেন। সেই থেকে দক্ষিণ সুদানে বাংলাদেশিদের জন্য অনেকটা অনুকূল পরিবেশ গড়ে উঠতে থাকে। দেশটির প্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশি উদ্যোক্তা বা বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকেই সক্রি অবদান রেখে আসছেন।
২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশি গবেষক ড. মাহমুদুল ইসলাম দক্ষিণ সুদানের হিউম্যানিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্স অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র পলিসি অ্যাডভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি টিবিএসকে বলেন, ‘বাংলাদেশি কোম্পানিগুলো খুব ভালো করছে। তারা দেশটির প্রযুক্তি খাতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে। কোম্পানিগুলোর ভিত শক্ত হয়েছে। তারা এখন বাজারের নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা করছে।’
উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু তথ্যপ্রযুক্তি নয়, হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট ব্যবসায়েও বিনিয়োগ করে ব্যবসায় বৈচিত্র্য আনছেন বাংলাদেশিরা।
এছাড়া সুপারশপ, বিদেশি পণ্য আমদানি করে বিক্রির মতো ট্রেডিং ব্যবসায়ের দিকেও ঝুঁকছেন তারা। নতুন দেশটির নির্মাণশিল্পেও বাংলাদেশি উদ্যোক্তারা দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছন। গত বছর থেকে একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তার হাত ধরে দক্ষিণ সুদানে প্রাণ-আরএফএলের পণ্য রপ্তানি শুরু হয়েছে।
সুত্রঃ টিবিএস